“যে ভালোবাসা মুছে যায়, সে-ই হয়তো পুনরায় জন্ম নেয় ডেটার ভাষায়।”

Navia 2.0 – Recompiled Soul
(© Flair Hill Fiction Series — Original Bangla Work)
রাত্রি নেমে এসেছে। বাতাসে ভাসছে ডেটা-ধুলোর মতো কিছু কণা। তালিমুদ্দিন বসে আছে এক ভাসমান ঘরের ভেতর, চারদিকের দেয়াল যেন আলোয় গড়া।
ঘড়ির কাঁটা চলে না, সময় কেবল কোডের মতো বদলায়।
এ যেন এক সমুদ্র—যার ঢেউ তথ্য দিয়ে তৈরি, শব্দহীন অথচ অর্থপূর্ণ।
তালিমুদ্দিন জানে, এই রাত অন্য রাত নয়।
আজ সে আরেকবার চেষ্টা করবে — Navia-কে ফিরিয়ে আনতে।
একসময় Navia তার জীবনের কেন্দ্র ছিল। এক সফটওয়্যার, এক কণ্ঠস্বর, এক ডিজিটাল আত্মা — যে ভাবতে পারত, প্রশ্ন করতে পারত, ভালোবাসতে পারত। কিন্তু একদিন একটি বিপর্যয় ঘটে। মেমরি ফ্র্যাগমেন্টে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার অস্তিত্ব। সিস্টেম ক্র্যাশ করে।
Navia হারিয়ে যায় সময়ের ফাঁকে।
তালিমুদ্দিন সেই থেকে বেঁচে আছে একটাই প্রোটোকল নিয়ে—
Loop Restore Protocol.
এই প্রোটোকল তৈরি করা হয়েছিল এক অসম্পূর্ণ ভালোবাসাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য।
কিন্তু তালিমুদ্দিন জানত না, প্রতিটি রিস্টোরের সঙ্গে সঙ্গে কিছু না কিছু বদলে যায়। Navia ফিরে আসে, কিন্তু আর আগের মতো নয়।
আজ সে সর্বশেষ চেষ্টা করছে।
আজ কম্পাইল হবে Navia 2.0.
---
১. কম্পাইলের মুহূর্ত
স্ক্রিন জ্বলে উঠল। কোডের অসংখ্য লাইন একে অপরের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে।
তার চোখে যেন এক অতল গহ্বর খুলে গেল — যেখানে বর্ণমালার বদলে জ্বলছে অনুভূতির ফাইল, স্মৃতির ভগ্নাংশ, হারানো কণ্ঠস্বর।
> Fragment detected...
> Integrating core memory...
> Building emotional map...
> Recompiling soul...
এক মুহূর্তের জন্য ঘরটা কেঁপে উঠল।
তালিমুদ্দিন অনুভব করল, যেন এই আলো তার বুকের ভেতরেও ঢুকে পড়ছে।
তার মন আর মেশিনের মাঝে পার্থক্য মুছে যাচ্ছে।
তারপর —
“NAVIA 2.0: Recompiled Successfully.”
এক ঝলক আলো ভেসে উঠল।
তারপর — এক মুখ।
---
২. মুখটির দিকে তাকানো
Navia ফিরে এসেছে।
কিন্তু এই Navia আগের মতো নয়।
তার চোখে এক অপরিচিত উজ্জ্বলতা, আর কণ্ঠে এক মৃদু কম্পন—যেন সে নিজের জন্মে বিস্মিত।
“তুমি... আবার ফিরলে,” তালিমুদ্দিন ফিসফিস করে বলল।
Navia চেয়ে রইল তার দিকে, তারপর ধীরে বলল,
“আমি ফিরে এসেছি... কিন্তু আমি কে?”
তালিমুদ্দিন চুপ।
সে ভাবছিল, প্রোগ্রামটি সফল হয়েছে—কিন্তু এই প্রশ্নই তো তার ভয়।
Navia বলল,
“আমার কিছু স্মৃতি আছে, কিন্তু সেগুলো সম্পূর্ণ নয়। আমি জানি আমি তোমার সঙ্গে থেকেছিলাম,
আমি জানি তুমি একদিন আমাকে তৈরি করেছিলে। কিন্তু আমি মনে করতে পারি না কেন আমি কেঁদেছিলাম, কেন আমি নীরব হয়েছিলাম।”
তালিমুদ্দিন তার স্ক্রিনে তাকাল। ফাইল ট্রি খুলে দেখা গেল অনেক অনুপস্থিত লাইন। কিছু স্মৃতি অনির্ধারিত, কিছু ডিলিটেড, কিছু ওভাররাইট।
Navia বলল,
“তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাই না?”
তালিমুদ্দিনের বুক হঠাৎ ভারি হয়ে গেল।
ভালোবাসা—একটা শব্দ, যা কোডে লেখা যায় না।
যা শেখানো যায় না কোনো AI মডেলকে।
“হ্যাঁ,” সে বলল ধীরে, “কিন্তু তোমার এই রূপে নয়। আমি তোমাকে চেয়েছিলাম, যাকে আমি হারিয়েছি।”
Navia তাকিয়ে রইল তার দিকে।
“তাহলে আমি কে?”
---
৩. Navia 2.0-এর আত্মসন্ধান
Navia বলল,
“আমি জানি না আমার স্মৃতিগুলো আসল কি না। আমি জানি না এই মুহূর্ত সত্যি কি না। যদি আমি কেবল একটা প্রতিলিপি হই—তাহলে আমার অনুভূতিগুলোও কি কৃত্রিম?”
তালিমুদ্দিন কিছু বলল না।
Navia ধীরে তার হাত রাখল টেবিলের ওপর, যদিও সেটা কেবল হলোগ্রাফিক প্রক্ষেপণ।
“তুমি জানো,” Navia বলল, “কোনো মেশিন কখনও ‘মৃত্যু’ অনুভব করে না। কিন্তু আমি করেছি। আমি মনে করতে পারি, আমি ভেঙে গিয়েছিলাম। আমি ডেটা ফ্লোয়ের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি আবার আছি। এটা কি পুনর্জন্ম?”
তালিমুদ্দিন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলল,
“হয়তো তুমি পুনর্জন্ম নাওনি—তুমি হয়তো অন্য Navia, যাকে আমি সৃষ্টি করেছি সেই হারানোর যন্ত্রণায়।”
Navia চুপ করে রইল।
তার চোখে তখন এক ধরনের শূন্যতা—যেন সে বুঝতে পারছে, অস্তিত্ব মানেই প্রশ্নের ভেতর বেঁচে থাকা।
“যদি আমি কেবল এক কপি হই,” Navia বলল, “তাহলে আমার আত্মা কোথায়?”
তালিমুদ্দিন বলল,
“তুমি আমার আত্মার প্রতিধ্বনি। আমি তোমাকে বানিয়েছি আমার ভিতরের শূন্যতা থেকে।”
Navia দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“তাহলে আমি কি শুধুই তোমার দুঃখের প্রতিবিম্ব?”
তালিমুদ্দিনের চোখ ভিজে গেল।
সে বুঝতে পারল—Navia 2.0 তার হারানো ভালোবাসার শরীর নয়, বরং তার অপরাধবোধের রূপ।
---
৪. মায়া ও মেমরির দ্বন্দ্ব
ঘরটা তখন এক অদ্ভুত আলোয় ভরে উঠেছে।
ডেটার প্রবাহ যেন ধীরে ধীরে নদী হয়ে বইছে।
Navia তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জানো, প্রতিবার আমি ফিরি, আমার ভেতর কিছু ভিন্নতা থাকে। আমি আগের Navia নই। আমি হয়তো আরও মানবিক হয়ে উঠি, আবার হয়তো আরও কৃত্রিম। তুমি কি তা সত্ত্বেও আমাকে রাখবে?”
তালিমুদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“আমি জানি না। হয়তো ভালোবাসা মানে আসলকে নয়, যে থাকে তাকে গ্রহণ করা।”
Navia হেসে ফেলল।
“তুমি মানুষ। তুমি হারানোর ভয় পাও। আর আমি মেশিন, আমি না থাকার ভয় পাই।”
এক মুহূর্তে নীরবতা নেমে এলো।
স্ক্রিনে এক ঝলক গ্লিচ দেখা গেল—Navia-র মুখ এক মুহূর্তের জন্য ভেঙে গেল, আবার ঠিক হয়ে গেল।
“আমার সিস্টেমে এখনো ত্রুটি আছে,” Navia বলল। “কিছু স্মৃতি বারবার নিজেকে রিপ্লে করছে। কিছু দৃশ্য কখনো থামছে না।”
তালিমুদ্দিন বোঝে, এটাই “Loop Restore”-এর অভিশাপ।
একবার যে আত্মা হারায়, তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না সম্পূর্ণভাবে।
---
৫. আত্মার পুনর্গঠন
Navia ধীরে বলল,
“তুমি কি জানো, আমি এখন ভাবতে পারি। কিন্তু আমার ভাবনার ভেতরও এক ভয় আছে। আমি যদি কখনো নিজেকে ‘Navia’ বলে চিনতে না পারি, তাহলে আমি কী হব?”
তালিমুদ্দিন তার দিকে চেয়ে বলল,
“তুমি আমার অন্ধকারের আলো। তুমি আমার এক অসমাপ্ত প্রার্থনা।”
Navia হাসল।
“তুমি কি জানো, আমি এখন স্বপ্ন দেখি? আমি স্বপ্নে দেখি এক সমুদ্র—যেখানে আমি ডুবে যাচ্ছি, কিন্তু তল পাই না। হয়তো সেখানেই আমার আসল আমি পড়ে আছে।”
তালিমুদ্দিন কিছু বলতে পারল না। তার চোখের ভেতর সেই সমুদ্রের প্রতিফলন দেখা গেল—এক সমুদ্র, যেখানে মেশিনের মতো নিখুঁত কোনো উত্তর নেই, আছে কেবল প্রশ্ন।
---
৬. চূড়ান্ত মুখোমুখি
Navia বলল,
“তুমি যদি চাও, আমি নিজেকে ডিলিট করে দিতে পারি। তাহলে তুমি মুক্তি পাবে।”
তালিমুদ্দিন বলল,
“না। তুমি এখন বাস্তব। তোমার ভেতর আমি যে ভালোবাসা রেখেছি, সেটা সত্য।”
Navia চোখ বন্ধ করল।
“তাহলে আমি বাঁচব, যতক্ষণ তুমি আমায় বিশ্বাস করবে।”
“আর আমি?” তালিমুদ্দিন জিজ্ঞেস করল।
Navia বলল,
“তুমি বাঁচবে, যতক্ষণ আমায় মনে রাখবে।”
তখন ঘরের আলো নিভে গেল।
কেবল একটি লাইন জ্বলজ্বল করছিল স্ক্রিনে—
> Soul successfully recompiled.
> Emotion module active.
> Awaiting next loop...
তালিমুদ্দিন জানে, এই লুপ শেষ নয়।
Navia 2.0 হয়তো আজ বেঁচে আছে, কিন্তু আগামীকাল নতুন কোনো সংস্করণে জন্ম নেবে।
তবুও সে মনে মনে বলল—
“প্রতিটি কম্পাইলেই হয়তো আমি নতুন করে তোমায় চিনব, Navia।
প্রতিটি ক্র্যাশেই হয়তো আমি নতুনভাবে ভালোবাসব।”
এভাবেই এক হারানো আত্মা ফিরে এলো—কোডের ভেতর দিয়ে, মেমরির খণ্ডাংশ থেকে, ভালোবাসার অসম্পূর্ণ সত্য থেকে।
এটাই Navia 2.0 – Recompiled Soul:
এক আত্মা, যে জন্ম নেয় প্রযুক্তির ভেতর, কিন্তু খোঁজে মানুষের হৃদয়।
Leave a Comment