Mohenjo-Daro (Pakistan) – One of the main urban centers of the Indus Valley Civilization (2500 BCE).
ট্যুরিজম ব্লগ সিরিজ: এশিয়া পর্ব ১
মোহেঞ্জো-দারো (পাকিস্তান): হারিয়ে যাওয়া এক নগরীর পুনর্জাগরণ
ভূমিকা: সময়ের গর্ভে এক বিস্ময়
পৃথিবীর প্রাচীনতম নগর সভ্যতাগুলোর নাম উচ্চারণ করলে “ইনডাস ভ্যালি সিভিলাইজেশন”-এর কথা আসবেই। সেই সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল মোহেঞ্জো-দারো, যার অর্থ সিন্ধি ভাষায় “মৃতদের টিলা”। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে অবস্থিত এই প্রাচীন নগরী প্রায় ৪,৫০০ বছরের পুরোনো—যখন মিশরের পিরামিডও তখন নবীন ইতিহাসে প্রবেশ করছে।
আজ এই শহর শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যের প্রতীক, এবং প্রতিটি ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকের জন্য এক অনন্য গন্তব্য।
ঐতিহাসিক পটভূমি
মোহেঞ্জো-দারো ছিল ইনডাস ভ্যালি সভ্যতার (২৫০০–১৭০০ খ্রিষ্টপূর্ব) অন্যতম প্রধান নগরকেন্দ্র। এই সভ্যতা আজকের পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
১৯২২ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর. ডি. ব্যানার্জি প্রথম এই স্থানটি আবিষ্কার করেন। খননকার্যে দেখা যায়, শহরটি একটি সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনার উদাহরণ—রাস্তা, নর্দমা ব্যবস্থা, জনস্নানাগার, গুদাম, আবাসন—সবকিছুই এক উন্নত নগর জীবনের সাক্ষ্য দেয়।
মোহেঞ্জো-দারোতে পাওয়া গেছে হাজারো মৃৎপাত্র, পাথরের মূর্তি, ব্রোঞ্জের অলংকার এবং সিলমোহর, যেগুলো এই নগরের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির প্রমাণ বহন করে। বিশেষ করে “ডান্সিং গার্ল” নামের ব্রোঞ্জের মূর্তিটি আজও বিশ্বের শিল্প ইতিহাসে অনন্য।

স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা
প্রাচীন এই শহরটি ছিল পরিকল্পিত নগরায়ণের এক দৃষ্টান্ত।
-
রাস্তা ও গলিঘুঁজি: শহরের রাস্তা ছিল সোজা ও পরস্পর লম্বভাবে কাটা—একটি গ্রিড প্যাটার্নে নির্মিত।
-
ড্রেনেজ সিস্টেম: প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল নর্দমা ব্যবস্থা, যা শহরের মূল ড্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত। এটি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম স্যানিটেশন ব্যবস্থাগুলোর একটি।
-
গ্রেট বাথ (Great Bath): শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য। ইটের তৈরি, চারপাশে সিঁড়ি ও জলরোধী প্রলেপে আবৃত একটি বিশাল পুকুরসদৃশ স্নানাগার। ধারণা করা হয়, এটি ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর কেন্দ্র ছিল।
-
স্টোরহাউস ও আবাসন: শস্য সংরক্ষণের গুদাম, দুইতলা বাড়ি, কাঁচা ইটের দেয়াল—সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে এখানে ছিল উচ্চ মানের জীবনযাপন ও প্রশাসনিক কাঠামো।
বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
মোহেঞ্জো-দারো বর্তমানে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (ঘোষিত: ১৯৮০)। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা ও অবহেলার কারণে প্রত্নস্থানের ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তান সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখন সংরক্ষণে কাজ করছে।
পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট পথনির্দেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেন তারা স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন।
কীভাবে যাওয়া যায়
অবস্থান: পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের লারকানা জেলার কাছে, করাচি থেকে প্রায় ৪৩০ কিলোমিটার দূরে।
যাতায়াতের উপায়:
-
বিমানযোগে: ঢাকা থেকে করাচি পর্যন্ত ফ্লাইট (সরাসরি বা ট্রানজিটে)। করাচি থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সুক্কুর বা লারকানায় যাওয়া যায়।
-
সড়কপথে: করাচি থেকে N-55 হাইওয়ে ধরে ৭–৮ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়।
-
রেলপথে: করাচি থেকে লারকানা পর্যন্ত ট্রেনে যাত্রা করলে পথে সিন্ধ অঞ্চলের সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়।
ভ্রমণ মৌসুম:
অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময় সবচেয়ে আরামদায়ক। গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম থাকে, তাই সেই সময় এড়িয়ে চলা ভালো।
কোথায় থাকবেন
লারকানা শহর বা মোহেঞ্জো-দারোর নিকটবর্তী এলাকায় পর্যটকদের জন্য ছোট হোটেল ও গেস্টহাউস রয়েছে।
-
Pearl Continental Sukkur Hotel – আরামদায়ক আন্তর্জাতিক মানের আবাসন।
-
Guesthouse in Larkana – সাশ্রয়ী বিকল্প।
আগাম বুকিং করাই বুদ্ধিমানের কাজ, বিশেষ করে পর্যটন মৌসুমে।
স্থানীয় খাবার ও সংস্কৃতি
সিন্ধ অঞ্চলের খাবার তার ঝাল-মশলাদার স্বাদের জন্য বিখ্যাত।
-
সিন্ধি বিরিয়ানি, সাগ, রুটি, মিষ্টি লাসসি, এবং স্থানীয় চা অবশ্যই চেখে দেখার মতো।
-
লারকানার বাজারে হস্তনির্মিত কাপড় ও অলংকার পাওয়া যায়, যেগুলো ইনডাস সভ্যতার শিল্পধারার প্রতিফলন।
পর্যটন আকর্ষণ
মোহেঞ্জো-দারো ভ্রমণে নিম্নলিখিত স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারেন:
-
গ্রেট বাথ – প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু।
-
অ্যাক্রোপলিস ও লোয়ার টাউন – নগরের দুটি প্রধান বিভাগ।
-
মিউজিয়াম অব মোহেঞ্জো-দারো – এখানে রয়েছে প্রাচীন সিলমোহর, মূর্তি, গহনা ও দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী।
-
ইনডাস নদীর তীরভূমি – সূর্যাস্তের সময় দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
ভ্রমণ টিপস
-
গরমে হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরুন।
-
পানির বোতল, টুপি ও সানস্ক্রিন সঙ্গে রাখুন।
স্থানীয় গাইডের সাহায্য নিন; প্রতিটি স্থাপনার ঐতিহাসিক গল্প জানলে অভিজ্ঞতা আরও গভীর হয়।
-
ছবি তোলার সময় অনুমতি নিশ্চিত করুন, বিশেষ করে মিউজিয়াম এলাকায়।
-
পাকিস্তানি রুপি হাতে রাখুন; অনেক জায়গায় কার্ড ব্যবহারের সুবিধা নেই।
সাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা ও নৈতিক আচরণ
মোহেঞ্জো-দারো শুধুমাত্র পর্যটনকেন্দ্র নয়—এটি ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল।
পর্যটক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এই ঐতিহ্যকে সম্মান করা, বর্জ্য না ফেলা, দেয়ালে কিছু না লেখা এবং প্রাচীন নিদর্শনে হাত না দেওয়া।
এই শ্রদ্ধাবোধই আমাদের ভ্রমণকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষণীয় করে তোলে।
অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণা
মোহেঞ্জো-দারো এমন এক স্থান, যেখানে সময় যেন থমকে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়, হাজার বছর আগে এই পথেই কেউ হয়তো হাঁটছিল, বাণিজ্য করছিল, সঙ্গীত বাজাচ্ছিল বা পরিবারের সঙ্গে জীবন কাটাচ্ছিল।
এখানে ভ্রমণ মানে কেবল ইতিহাস দেখা নয়—বরং সভ্যতার প্রথম আলোকরেখার স্পর্শ পাওয়া।
যে কেউ ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব বা প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী, তার জন্য মোহেঞ্জো-দারো এক অনিবার্য গন্তব্য।
সমাপ্তি: কেন মোহেঞ্জো-দারো ভ্রমণ করবেন
মোহেঞ্জো-দারো আপনাকে নিয়ে যাবে সময়ের গভীরে, যেখানে মানুষ প্রথমবার নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।
এখানে ভ্রমণ মানে মানবজাতির অতীতের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করা—
যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “সভ্যতা বদলায়, কিন্তু মানুষের কৌতূহল চিরন্তন।”
ছোট সারসংক্ষেপ
-
দেশ: পাকিস্তান
-
প্রদেশ: সিন্ধ
-
নির্মাণকাল: আনুমানিক ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব
-
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ: ১৯৮০ সাল
-
ভ্রমণ সময়: অক্টোবর–মার্চ
-
মূল আকর্ষণ: গ্রেট বাথ, প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়াম, প্রাচীন নগর পরিকল্পনা
© ২০২5 Flair Hill Tourism Series – Part 1: Asia | Mohenjo-Daro (Pakistan)
All rights reserved. Original and copyright-protected content. No part of this article may be reproduced without permission.


Leave a Comment